• Home
  • Blog
  • Blog

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এক মুসলিম উপজাতীয় সম্প্রদায়ের কথা

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী মনিপুরি মুসলিম বলছি মণিপুরী মুসলিমদের কথা , অনেকে হয়তো জানেনই না যে উপজাতির ভেতর মুসলিম আছে বা থাকতে পারে মণিপুরী মুসলিমরা হচ্ছে একটি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী যারা মূলত বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে ।

এদের কে পাঙ্গাল (মৈতৈ, পাঙ্গান মৈতৈ পানগাহাল(মৈতৈ বা মৈতৈ নামেও ডাকা হয় ।

সিলেটের মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় এদের বেশী বসবাস। মণিপুরী মুসলিম দের স্হানীয় ভাবে খাই বাঙ্গাল বা মুসলিম মনিপুরী বলা হয়।

ভাষাগত এবং ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশে মণিপুরীরা তিনটি শাখায় বিভক্ত। বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও পাঙ্গাল । এর মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়ার সংখ্যাই বেশি। বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ হিন্দুধর্মে এবং পাঙ্গাল মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসী। সব মিলিয়ে জনসংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। শাখা তিনটি হলেও সব মণিপুরীর প্রায় একই সংস্কৃতি। তাদের ভাষা, বর্ণমালা, সাহিত্য ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এদেশে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা।

পাঙ্গাল জাতিসত্তা বাংলাদেশের অন্যান মুসলমানদের মতোই নামাজ, রোজা নিয়মিত পালন করে এবং পবিত্র কুরআন শরীফ বিশ্বাসী। এদের সাধারণত নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে হয়।

ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও পাঙ্গালরা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং ঐতিহ্য আজও বজায় রেখেছে। তাদের ঘরবাড়ি, পোষাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা স্বতন্ত্র এবং বৈচিত্রে ভরপুর।

পাঙ্গালদের বাংলাদেশে আগমণের ইতিহাস

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও যুদ্ধজনিত কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের অধিবাসীরা বিভিন্ন সময় দেশত্যাগ করে। তখন অনেকে পাকিস্তান-ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় মণিপুরী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। এখন দেশে যে কয়টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম মণিপুরী সম্প্রদায়। পাঙ্গাল জাতির নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনের ইতিহাস মণিপুরীদের অপরাপর শাখা বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈদের থেকে আলাদা যদিও তিনটি জনগোষ্ঠিই অষ্টাদশ শতাব্দিতে আদিভূমি মণিপুর ত্যাগ করে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে তোলে।

পাঙলদের উৎসভূমি হলো ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর। ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের তৎকালীন মহারাজ খাগেম্বার আমলে প্রথমবারের মত মণিপুরী মুসলিমরা মণিপুরে বসতি স্থাপন শুরু করেন।

মণিপুরে মুসলমানদের সর্বপ্রথম এবং সর্ববৃহৎ অভিভাসন ঘটে মুঘল আমলে। সে কারনে ইতিহাসবিদদের ধারনা "পাঙন" শব্দটি এসেছে "পাঙ্গাল" শব্দ থেকে যার উৎপত্তি "মুঘল" থেকে (পাঙ্গাল>মুঙ্গাল>মুগাল এভাবে)। অনেকে আবার পাঙ্গাল শব্দটিকে "বাঙ্গাল" শব্দের বিবর্তিত রূপ বলেও মনে করেন।

মহারাজ খাগেম্বার ছোট ভাই সানোংবা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে ক্ষমতা দখলের লক্ষে তার অনুসারীদের নিয়ে মণিপুরের পার্শ্ববতী কাছাড় রাজ্যে আশ্রয় নেন।

R.K. Jhaljit Singh এর ‘A Short History of Manipur’; Jodunath Sarker এর ‘History of Bengal (Muslim Period)’; Quaji Hamid Ali এর ‘The Manipuri Muslim’; Iboonghal Singh Introduction to Manipur’ ইত্যাদি ঐতিহাসিক গ্রন্থ পাঠে জানা যায় যে, ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে সানোংবা কাছাড় রাজার সাহায্যে কাছাড়ের অধিবাসীদের নিয়ে একটি সৈন্যবাহিনী সংগঠিত করেন (যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান) এবং প্রথমবারের মত মণিপুর আক্রমণ করেন।

সানোংবা মুসলমানদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তার বাহিনী মণিপুর আক্রমর করতে পারলে তাদেরকে সম্মানজনক পদক, সরকারি উচ্চপদসহ মণিপুর রাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দেয়া হবে কিন্তু সে যুদ্ধে তাঁরা জয়লাভে ব্যার্থ হন।

Iboonghal Singh এর ‘Introduction to Manipur’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, “In 1603 A.D, The Mayang invaded Manipur but treaty was concluded.”  (এ উক্তিতে Mayang বলতে বাংলা ভাষাভাষীদেরকে বুঝানো হয়েছে)।

পুনরায় সানোংবা সৈন্যবাহিনী সংগঠিত করতে যান এবং কাছাড় রাজার পরামর্শে তৎকালীন সিলেটের শাসনকর্তা বায়েজীদ কররানীর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন।

কাছাড় রাজার অনুরোধে বায়েজীদ কররানী বর্তমান সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার তরফ, বানিয়াচং, বকাইনগর ইত্যাদি জায়গা থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ১৬ জন সেনানায়কসহ ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে মণিপুর আক্রমণের জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন।

সানোংবাসহ মুসলমান সৈন্যবাহিনী প্রধান মোহাম্মদ সানী তাঁর বাহিনী নিয়ে কাছাড় ও মণিপুরের সীমান্তবর্তী পাহাড় অতিক্রম করে বিষ্ণুপুরের নিকটবর্তী এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে ব্যাপক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।

অপরদিকে রাজা খাগেম্বা শত্রু পক্ষের আক্রমণের প্রস্তুতির খবর পেয়ে তিনি নিজে সেনাধ্যক্ষ হয়ে “থৌবাল” নামক এলাকায় থেকে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

এই যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের এই যুদ্ধে মুসলমানবাহিনী পরাজয় বরণ করে এবং ৩০টি হাতি, অসংখ্য হাতবন্দুকসহ মহারাজ খাগেম্বার হাতে বন্দী হন।

আবার ভিন্ন মতাবলম্বীদের মতে ঐ ব্যাপক যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল সন্ধির মাধ্যমে।

অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধের পরবর্তী সময়েই সন্ধির মাধ্যমে মুসলমান বীর সেনানায়করা মণিপুরী মেয়ে বিয়ে করে মণিপুরের ‘লিলং’ অঞ্চলে প্রথমবারের মত বসতি স্থাপন করেন।

কথিত আছে যে, মুসলমান বাহিনী প্রধান মোহাম্মদ সানী মহারাজ খাগেম্বার ছোট রাণীকেই বিয়ে করেছিলেন সন্ধি মোতাবেক।

ফলে সৃষ্টি হয় “মাতা মণিপুরী ও পিতা মুসলমান” এর সমন্বয়ে নতুন এক সম্প্রদায়, যার নাম “মৈতৈ পাঙল” বা “মণিপুরী মুসলিম”।

অতঃপর তাদের মধ্যে বার্মা (মিয়ানমার)-মণিপুর যুদ্ধের সময় (১৮১৯-১৮২৫) তৎকালীন মণিপুরের রাজা চৌরজিৎ সিংহ, তার দুই ভাই মারজিৎ সিংহ ও গম্ভীর সিংহসহ আশ্রয় গ্রহণ করেন বৃহত্তম সিলেট অঞ্চলে।

১৮১৯ থেকে ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দ এই সাত বছর কাল মণিপুরের ইতিহাসে ‘চহী তারেৎ খুনতাকপা’ বা ‘Seven Years Devastation’ নামে খ্যাত।

এ সাত বছর মণিপুর ব্রহ্মবাহিনীর করতলগত ছিল এবং অন্যায় অত্যাচার খুবই চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ঐ সময়েই অধিকাংশ মণিপুরী মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আগমন ঘটেছিল।

বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। R.K. Jhaljit Singh তার ‘A Short History of Manipur’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন ‘There are Pathans and Mughals among the Manipuri Muslim.’

মুসলিম মনিপুরীদের পাঠান রক্ত আর মৈতৈ রক্ত নিয়ে যে কাহিনী প্রচলিত আছে সেটা নিয়ে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ঠ মতপার্থক্য আছে। মণিপুরী রাজবংশের ইতিহাস 'চৈথারোল কুমবাবা'তে ভিন্ন কথা বলা হয়েছে। মৈতৈ গবেষক ঝালজিৎ সিংহ তাদেরকে মোগল বংশধর বলেছেন। অন্যদিকে আর ব্রাউন, গাঙ্গুমেই কাবুই প্রমুখ লেখকরা বলেছেন কাছাড়ি/বাঙালিদের বংশধর। অধুনাকালের গবেষনায় পাঙ্গালরা খ্রীষ্ঠিয় ৭ম শতকের আগে মণিপুরে ছিল এমন কথাও দাবী করা হচ্ছে আরো জানতে -Click Here

খাদ্যাভ্যাস

বাংলাদেশে অবস্থানরত মণিপুরী মুসলিমরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ন্যায় খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে থাকেন।

ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও মনিপুরি মুসলিমরা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং ঐতিহ্য আজও বজায় রেখেছে।তাদেরঘরবাড়ি,পোষাক-পরিচ্ছদ খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা স্বতন্ত্র এবং বৈচিত্রে ভরপুর।

তথাপি নিজস্ব কিছু খাবার রয়েছে। যেমন- মরই তল (বাখর পিঠা), চিনি তল (চিনির পিঠা), তানজাম (চালের পিঠা), কাংদ্রুম (গোল ধরনের চালের পিঠা), তামাই জাম, চেগাই তল ইত্যাদি পিঠা জাতীয় খাবার।

তাছাড়াও উতংচাক (বাঁশের চোঙার ভাত), উতি (কলার দন্ড দিয়ে তৈরী তরকারী), সুঞ্জু, লাফু, উসই, থরো, ঙামু, হাংগাম সুঞ্জু (বিভিন্ন ধরনের চাটনি), হাওয়াই (হালিমের মত) ইত্যাদি খাবার উল্লেখযোগ্য।

ধর্ম ধর্মীয় উৎসব

পাঙ্গাল সমপ্রদায়ের আদি পিতা ছিলেন মুসলিম এবং আদি মাতা হলেন মণিপুরী। ফলে এ সম্প্রদায়ে ইসলামী ও মণিপুরী সংস্কৃতির সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়।

পাঙ্গালরা সুন্নী মুসলিম।নানান সামজিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তারা মাতৃভাষা ও ঐতিহ্যকে গুরুত্ত্ব দিয়ে থাকে। তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে কোরান শরীফের তর্জমা ও তাফসীর, বিভিন হাদিসের পাঠ ও ব্যাখ্যা সবকিছু মাতৃভাষায় করা হয়ে থাকে। এছাড়া বিয়ের দিনে "কাসিদা" নামে পরিচিত এক ধরনের লোক ঐতিহ্যবাহী বিয়ের গান ও নাচের অনুষ্ঠান থাকে যা পাঙনদের একান্ত নিজস্ব।

ঈদ পাঙ্গালদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। ঈদের দিনে গোত্র বংশ নির্বিশেষে সব শ্রেণীর পাঙ্গাল এক কাতারে সমবেত হয় এই বিশেষ দিনটিকে উদযাপন করার জন্য। ঈদের জামাতও নির্দিষ্ঠ স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। মসজিদে, দোকানে, হাটবাজারে, খেয়াঘাটে সবখানে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পালা চলে। আত্মীয় স্বজন ও পরিচিত জনদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হয়। পরিবারের সবার জন্য নতুন জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করা হয়। ঈদের দিনে পাঙ্গাল মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক পড়ে দল বেঁধে আত্মীয় স্বজনের বাড়ী বেড়াতে যাওয়ার দৃশ্য চেয়ে দেখার মতো।

তাছাড়া ঈদের দিন একটি নির্দিষ্ট বাড়ীতে পঞ্চায়েতের সবাই একত্রে দুপুরের খাবার খেয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন, যা যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করছে।

প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ উপলক্ষে পাঙ্গাল সম্প্রদায় প্রতিটি ঘরে ঘরে ঐতিহ্যবাহী খাবার আইটেম যেমন- মারই তল (বাখর পিঠা), চিনি তল (চিনির পিঠা), তানজান (চালের পঠা) কাম, চুহি লুপপি ইত্যাদি ঈদের আনন্দের আমেজে তৈরী করা হয়।

পাঙ্গাল সম্প্রদায়ের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা

পাঙ্গাল সম্প্রদায়ের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা খুবই সুদৃঢ়। যে কোন ধরনের অনুষ্ঠান, সম্পূর্ণ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বা তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করা হয়।

অনুষ্ঠান সম্পাদনে প্রয়োজনীয় উপাদান যেমন- চাল, মাংস, মসলা, হাড়ি-পাতিল, লাকড়ি, মাদুর, পান সুপারি, ইত্যাদি সবকিছু পঞ্চায়েত থেকে সংগৃহিত হয়।

উল্লেখ্য যে, যে-কোনো সিরনিতে ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোনোরকম ভেদাভেদ ছাড়াই একত্রে সবাই মাটিতে বিছানো মাদুর (ফিদা)-এ বসে এবং পঞ্চায়েতের কোন মুরব্বীর বিসমিল্লাহ বলার মাধ্যমে সবাই বিসমিল্লাহ পড়ে খাওয়া শুরু করেন, যা অন্যত্র দৃষ্টিগোচর হয় না।

এখানে গরু ও মুরগীর মাংস ইত্যাদির সাথে ঐতিহ্যবাহী তরকারী আমথাকপা (হালিমের মত) ও এরি (মাংসের ঝোল) পরিবেশন করা হয়।

তাছাড়া পাঙল সম্প্রদায়ের কোনো লোক যখন মারা যান তখন তার আত্মীয়স্বজনসহ সমাজের সবাইকে মৃত্যুসংবাদ পৌছানোও পঞ্চায়েতের দায়িত্ব।

এখানে উল্লেখ্য যে, মৃত্যু সংবাদ যে কোনো গ্রামের শুধু একজনকে জানিয়ে দিলে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে, এভাবে আমের সর্বত্র সংবাদ ছড়িয়ে দেয় যা প্রত্যেকে নিজ দায়িত্ব মনে করে পালন করে থাকে।

মৃত্যুর দিন ঐ পরিবারের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা, গরীব দুঃখীদের মধ্যে চাল ও টাকা বিতরণ করা এবং রাতের বেলা যদি মারা যান তবে সারারাত জেগে পাশে কোরআন তেলাওয়াত করা, দোয়া-দরুদ পড়া এবং দাফনের পর কোরআন খতম করানোসহ যাবতীয় কাজ পঞ্চায়েতই সম্পাদন করে থাকে।

পাঙ্গন-দম্পতি

পাঙ্গন-দম্পতি

বিবাহ রীতি নীতি

পাঙল সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতার মধ্যে অন্যতম অংশ বিবাহ পর্ব। বিবাহ রীতি বাঙালী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের। পাঙ্গাল সমাজে ঘটক প্রথা চালু নেই।

বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা কতকগুলো পর্যায়ে বিভক্ত থাকে। বিয়ের আনুষ্ঠানিক পরে ছেলেপক্ষের নিকটআত্নীয়রা কনের বাড়িতে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয় এবং একে বলা হয় ‘হায়জাবা কাবা’।

এ পর্বে শুধু দেনমোহর সংক্রান্ত আলাপ আলোচনা অতঃপর চুড়ান্ত বাগদান পর্বের জন্য অনুষ্ঠিত হয় ‘কাপুবা’ বা পানচিনির ব্যাবস্থা।

এ পর্বে ফল মূল, মিষ্টি, পান-সুপারি, খই ইত্যাদি নিয়ে বর পক্ষের মহিলাগণ পুরুষদের পাশাপাশি লুথং বা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে কনের বাড়িতে যান এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহের দিনক্ষণ স্থির করে থাকেন।

বিয়ের পূর্বদিন রাতব্যাপী বর ও কনের বাড়িতে আলাদাভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং এটাকে বলা হল ‘পূরজাক’ ঐ অনুষ্ঠানে কনের পরনে থাকে ‘কমিন’ (বিশেষ ধরনের পোষাক), খেমদি ব্লাউজ ও মাথায় থাকে ব্যতিক্রমী কাজ ও ফুল দিয়ে ঝালর দেয়া ‘লৈত্রেং’ (গোলাকার)। অন্যদিকে বর থাকে স্বাভাবিক সাজে।

বর ও কনের উভয় অনুষ্ঠানে রাতব্যাপী চলে ঐতিহ্যবাহী পাঙল গান । যুবক-যুবতীসহ সবাই গানে মেতে ওঠে এবং এর সাথে যুক্ত হয় থাবালচংবা (পাঙাল নৃত্য)।

যুবক-যুবতীরা আলাদাভাবে কখনো বা যৌথভাবে এ নৃত্যে অংশগ্রহণ করে থাকে। পরেরদিন বাঙালীদের ন্যায় বর পাঞ্জাবী, পায়জামা, শেরওয়ানি ইত্যাদি পরিধান করে বন্ধু-বান্ধবসহ নিজ পঞ্চায়েতের লোকজনকে (পঞ্চায়েতের লোকজন বরযাত্রী হিসেবে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী) নিয়ে বরযাত্রী দল রওনা হন।

বরের যাত্রার সময় নিজের মা-বাবা ও মুরব্বীদের সালাম করে এবং দোয়া নিয়ে ঐতিহ্যবাহী চাদর ‘কাংথমফিদার’ উপর পা দিয়ে যাত্রা করতে হয়। বর যাত্রীগণ কার, লাইটেস ইত্যাদি নিয়ে কনের বাড়ীতে পৌঁছার পর মুরব্বীদের অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করে থাকেন।

কনের বাড়ীতে ওঠানে কাংথমফিদা দিয়ে বসানো হয়। উপস্থিত মুরব্বীদের উদ্দেশ্যে বরের পক্ষ থেকে গান পরিবেশন করতে হয়। পেছনে বালিশ দিয়ে বরকে বসানো হয়।

কনে বাড়ির মহল্লার ইমাম সাহেব ইসলামী তরিকায় কোরআন সুন্নাহ মোতাবেক বিয়ে পড়ান। তবে তিনজন গাওয়া উকিল (১জন উকিল ও ২জন সাক্ষী) থাকেন এবং উকিলের হাতে থাকে একটি লাঠি।

বর ও কনের আলাদাভাবে বসেন এবং নিচু স্বরে কবুল বলে থাকেন এবং গাওয়া উকিল তার সাক্ষী হন। অতীতে বর ধুতি পরিধান করে পালকি কিংবা হাতি দিয়ে যাত্রা করতেন।

তাছাড়া বিয়ের পর ‘ঙাইসেল খাংনাবা’ অর্থাৎ একে অন্যের দাওয়াত দিয়ে পরিচয় পর্বের আনুষ্ঠানিকতাও প্রচলিত রয়েছে।

কোমর তাঁতে পাঙন মেয়ে কাপড় বুনছে

কোমর তাঁতে পাঙন মেয়ে কাপড় বুনছে

পেশা

মহিলাদের প্রধান পেশা হলো বস্ত্রবয়ন এবং পুরুষগণের প্রধান পেশা হলো কৃষি। আর কৃষকদের নিত্যসঙ্গী ছিল ‘হুক্কা’ (হিদাকপু)। মনিপুরি মুসলিম মেয়েরা কৃষিকাজে পুরুষের সমান পারদর্শী। কৃষিকাজ ছাড়াও তারা বাঁশ ও বেত দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতি ও আসবাব তৈরীতে দক্ষ।

ঐতিহ্যবাহী এ হুক্কা সম্পকে Quazi Harnid Ali ‘Manipuri Muslim’ বই-এ উল্লেখ করেন : “The People of Bengal used to smoke tobacco with ‘Hukka’ a‘s they were accustomed in smoking tobacco with ‘Hukka’, they might introduce it in Manipur. In course of time smoking tobacco with prevailed in Manipur.” R.K. Jhaljit Singh rightly says- ‘Smoking of tobacco was introduced in 1610 and tobacco was cultivated as a new luxury.’

আর ‘Musalman Manipuri’ গ্রন্থে Abdul Bari লিখেছেন- ‘Till e business of tobacco and its cultivation are generally done by the Muslim.’

পোষাক পরিচ্ছদ

পাঙাল সম্প্রদায়ের পোষাক পরিচ্ছদের স্বতন্ত্রতা রয়েছে। পুরুষরা বাঙালীদের ন্যায় পোশাক ব্যবহার করেন এবং মহিলাগণ নিজস্ব কোমর তাঁতে তৈরী ‘ফানেক’ (কোমর পর্যন্ত প্যাচানো কাপড় পরে থাকেন।

এছাড়া কোমর তাঁতে কাপড় বোনা এবং সুচিকর্মে পাঙ্গাল মেয়েদের দক্ষতা রয়েছে। মণিপুরীদের পরিধেয় ফানেক বা চাকসাবির উপর পাঙ্গাল মেয়েদের সুঁই সুতার সুক্ষ কারুকাজ দেখলে বিস্মিত হতে হয়।মনিপুরি মুসলিম নারীদের নিপুণ হাতে গড়া পুরুষ ও মহিলাদের জন্য রকমারী পোষাকগুলো যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিঃসন্দেহ। কাপড়ের আঁচলে গাঁথা আর পরতে পরতে আঁকা রঙ-বেরঙের নকশাগুলো যেন সহসাই মনে করিয়ে দেয় মনিপুরী সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের কথা। তাঁতের প্রতিটি সুতার ফাঁকে যেন লোকিয়ে আছে মনিপুরী জীবনের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।

‘ফানেক’ বিভিন্ন রকমের হয়, যেমন- লাই, সালু, হাংগামপাল, সোনারং, চুমহাপ্পা, মকং; (বিভিন্ন ধরনের রং ও কাজ করা) ইত্যাদি।

বিবাহিত মেয়েরা লৈফানেক আরলবা, লৈফানেক মায়াইরনবি, সালু ফানেক আরনবা, লৈচিল ফানেক, উরেং আরনবা, উরেং চুমহাপ্পা, লৈচিল উরেং (বুক পর্যন্ত প্যাচানো বিভিন্ন রং ও ডিজাইনের কাপড়) ইত্যাদি পরিধান করে থাকেন। তাছাড়া কোমরে কাপড় প্যাচানো থাকে এবং সাথে ইন্নাফি বা খুদাই (ওড়না) পরে থাকেন।

বিবাহিতা মহিলারা বাহিরে কোথাও বের হলে বিশেষ ধরনের এক বোরকা ও ছাতা ব্যবহার করে থাকেন। এ সম্পর্কে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক মোহাম্মদ পত্রিকার মতিন উদ্দিনের উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে পারি-

“The Manipuri Muslim women did never come out on the street as half naked-full sleeve jacket entirely bottomed up to neck, dressed up to the sole of the feet a scarf on it, above all an umbrella on head. Face or anypart of the body of any Manipuri Muslim women (except the finger of hand and feet) can never see on the street.”

পাঙাল মহিলারা সামাজিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিজেদের ঐতিহ্যগত স্বর্ণের হার পরিধান করে। তবে বিশেষ ধর্মীয় সামাজিক অনুষ্টানে (বিয়ে) যুবকরা- পাঞ্জাবি, যুবতীরা লৈফানেক নামের কারুকার্যময় দামি এক ধরনের পোষাক পরিধান

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এসব পোশাক বাঙালিদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে উপজাতি পোশাক হিসেবে। মনিপুরী তাঁত শিল্প বা মনিপুরী তাঁতবস্ত্র আমাদের দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে একটি প্রধান আকর্ষণ।

আমার কয়েক'টা আটিক্যালের লিংক, এখানে ক্লিক করেই পড়তে পারেন-

কি ভাবে আপনার সন্তানের সাথে সেক্স নিয়ে কথা বলবেন?

পথে পথে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন থেমে যাবো

সবাই তো সুখি হতে চায় – আপনার কাছে সুখ মানে কি?

খেলুন ডুয়োলিঙ্গো: শিখুন নতুন নতুন ভাষা!

বন্ধুত্ব: ভালবাসা আর মায়ায় ভরা যে সম্পর্ক

Click Here to Leave a Comment Below 0 comments

Leave a Reply: