ঝিনুকে মুক্তো হলে চুপ হয়ে যায় মুখ খোলে না!
দার্শনিক ইমাম শা'বী (রহ.) বলেন-
‘জ্ঞানের তিনটি স্তর আছে; যে ব্যক্তি জ্ঞানের প্রথম স্তর অর্জন করে তার নাক উঁচু হয়ে যায়, এবং মনে করে যে সে জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছে।
আর যে ব্যক্তি জ্ঞানের দ্বিতীয় স্তর অর্জন করে সে নিজেকে ছোট মনে করতে শুরু করে, এবং বুঝতে পারে যে তার জ্ঞান অর্জিত হয় নি।
আর তৃতীয় স্তর হলো শুধু আফসোস আর আফসোস! হায় হায়, জ্ঞান তো কখনোই অর্জন করা সম্ভব নয়।’
আর এই সবগুলি স্তর পার করার পরও যখন কেও বুঝতে পারে না বাস্তবতা কি, সে আসলে কত কম জানে,উপরন্তু সে সব সময় ফ্যান্টাসির মধ্যে থাকে এবং এক অদ্ভুত কল্পনার জগতে বিচরন করে তাকে নিয়ে কিছু বলার নাই।
যাই হোক, প্রকৃত জ্ঞানী ব্যাক্তির জ্ঞানের এই স্তরের কথাই বলা হয়েছে নীচের কাব্যিক ভাষায় ।
“ঝিনুকে যখন মুক্তো হয় তখন সে আর মুখ খোলে না. সে তখন গভীর জলে চলে যায়, নদীর কিনারা দিয়ে সে তখন আর চলাচল করে না।“
সত্যিকারের জ্ঞানী ব্যাক্তির বৈশিষ্ট্যবলীঃ
সত্যিকারের জ্ঞানী ব্যাক্তির পরিচয় তার বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা এবং নিজেকে খুব বড় কিছু না ভাবার মধ্য দিয়ে। তথাকথিত জ্ঞানী ব্যাক্তি(পড়ুন শিক্ষিত ব্যাক্তি)রা দু একটা একাডেমিক সার্টিফিকেট অর্জন করেই জ্ঞানের অহমিকায় আকাশে উড়তে শুরু করে। অথচ প্রকৃতঅর্থে জ্ঞানী যারা, তারা সর্বদাই বিনয়ী এবং অবনত মস্তকে থাকেন। একজন মানুষের জ্ঞানের লেভেল যত বাড়তে থাকে, আরো জ্ঞান লাভের স্পৃহা আরো বেড়ে যায়। দুনিয়ার দৃশ্য অদৃশ্য, বড় ছোট, আসমান জমিনের অভ্যন্তরীণ সকল বিষয়ে তার জানার আগ্রহ দিনকে দিন বেড়েই যেতে থাকে। জ্ঞানের এক একেকটা শাখা যত বিস্তৃত হতে থাকে, একজন প্রকৃত জ্ঞানী ব্যাক্তি ততই বুঝতে থাকেন এই বিশ্ব-ব্রক্ষ্মান্ডের কত কিছু তার অজানা রয়ে গেছে, আরো কতকিছুই তার জানার বাকী রয়ে গেছে। ঘরের চার দেয়ালে বন্দী থেকে যেমন বাইরের দুনিয়া সম্মন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়া কঠিন, তেমনি মনের মধ্যে কুটিলতা, সংকীর্ণতা, অন্যের প্রতি অবহেলা ভাব অথবা ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাব থাকলে কখনোই জ্ঞানের উচ্চস্থানে নিজেকে সমর্পণ করা যায় না।
এজন্যই রুপক অর্থে এইরুপ জ্ঞ্যানি ব্যক্তির সত্যিকারের অবস্থা বোঝানোর জন্য বলা হয়ে থাকে, ঝিনুকে মুক্তো হলে তা চুপ হয়ে যায়, মুখ খোলে না।
ঝিনুক যেমন নিজের বুকে দামীমুক্তো নিয়ে বড়াই করে না বরংচ চুপচাপ নীরবে নিভৃতে নিজেকে সমর্পণ করে তেমনি জ্ঞ্যানি ব্যক্তিরা ও জ্ঞানের একটা পর্যায়ে গিয়ে নিজেকে জাহিরের আর চেষ্টা করে না। বরংচ সে বুঝতে শিখে, আরে, অযথা বড়াই করে লাভ কি!আমি আসলে কি জানি? এই ব্রক্ষ্মান্ডের অনু-পরমানু পরিমান ও তো আমি জানিনা। তাহলে আমি কিসের এতো বড়াই করবো? কিসের গরিমায় আমি অন্যজনকে ছোট ভেবে তাকে অবহেলা করবো?
জ্ঞান নিয়ে অহংকার নয়ঃ
জ্ঞান যত বেড়ে যেতে থাকে, জ্ঞানের বিশালতায়, জ্ঞানের মহিমায় ততই মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলতে থাকে।এই বিশাল জ্ঞানের ভান্ডারের তুলনায় নিজেকে তখন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না ওই ব্যক্তির কাছে।
ইসলামি দার্শনিক আবু তাহের মিসবাহ বলেন, ‘গাছের যে ডালে ফল ধরে সে ডাল ফলের ভারে ঝুঁকে অবনত থাকে, আর যে ডালে ফল নেই সে ডাল মাথা উঁচিয়ে থাকে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। এটাই চিরন্তন সত্য। মানব সমাজেও এ সত্যের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। যিনি যত বড় জ্ঞানী যত বড় গুণী তিনি তত বেশি বিনয়ী। পক্ষান্তরে যার জ্ঞানের পরিধি যত সঙ্কুচিত তার অহংকার তত বেশি স্ফীত!'
প্রকৃতপক্ষ্যে আসলে তাই কিন্তু ঘটে। একজন জ্ঞানী ব্যক্তির অন্তর চক্ষু এমনভাবে খুলে যায়, যে এই আসমান জমিনের মাঝখানে অথবা এই দুনিয়া ছাড়িয়ে সম্পুর্ন ব্রক্ষ্মান্ডের জ্ঞান সমুদ্রের বিশালতা তাকে অবাক করে। সে বুঝতে পারে তার জানার পরিমান কত কম, সে কতটা ক্ষুদ্র! এই ভাবনাতেই সে অতি বিনয়ী হয়ে চুপচাপ নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করা থেকে বিরত থাকে।
অপরদিকে জ্ঞানের প্রথমদিকে থাকা মানুষ, অথবা অল্প জানা মানুষ যাদের অন্তর্চক্ষু ঠিকঠাক খোলে না, অথবা মুর্খতার পর্দায় ঢাকা থাকে যাদের অন্তর্চক্ষু তারা তাদের ভাসা ভাসা ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়ে বুঝতেও পারে না জ্ঞান সমুদ্র কত বিশাল, কত বিস্তৃত। কত কিছুই না জানার সুযোগ রয়েছে, কত কিছুই যে আমরা জানিও না।
'তাই সে অল্পতেই জ্ঞানের বড়াই করে, নিজেকে মহাজ্ঞানী ভেবে অহংকার করে।’
ভাই, জ্ঞান নিয়ে অহংকারের কি আছে? কতটা আসলে জানেন আপনি এই বিশাল বিস্তৃত জ্ঞান সমুদ্রের? কোন মানুষের পক্ষ্যে কি সম্ভব সবজান্তা হয়ে উঠা? এই দুনিয়ার সকল কিছু একমাত্র আমাদের সৃষ্টিকর্তা নিজেই জানেন। আমরা আশরাফুল মাখলুকাত, আল্লাহপাক আমাদের খুবই কম জানার তৌফিক দিয়েছেন। এতো কম জেনে অন্য কাউকে অবহেলা করা, অহংকার করা এতে কোন ভালো ফলাফল বয়ে আনে না। অহংকার যদি করতেই হয়, আল্লাহপাক করবেন। তিনি এই বিশাল ব্রক্ষ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন, তিনি এর সবকিছু জানেন।আর তাই জ্ঞান নিয়ে অহংকার একমাত্র আল্লাহতায়ালাই করতে পারেন।
সুতরাং আমি আপনি সাধারণ মানুষ নিরহংকারী হয়ে নিজের সীমিত জ্ঞান যদি মানুষের মাঝে বন্টন করার চেষ্টা করি, আল্লাহপাক খুশী হয়ে আমাদের রহমত করবেন আমরা যেন আরো জ্ঞান অর্জন করতে পারি, আরো বেশী মানুষের উপকারে আসতে পারি।
অহংকারী জ্ঞানী ধ্বংস হবেইঃ
অহংকারী সে যতই জ্ঞানী হোক, ধ্বংস তার হবেই।আল্লাহ তা’য়ালা নিজেও অহংকারী জ্ঞানী ব্যাক্তি কে পছন্দ করেন না। খোদ ইবলিশ শয়তান তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। ইবলিশ ছিলেন জ্বিন জাতির এক অন্যতম জ্বিন এবং প্রায় ছয় বছর সে আল্লাহপাক এর ইবাদতে মশগুল ছিল। সে ইবলিশ যখন অহংকার দেখালো, আল্লাহর আদেশ অমান্য করলো তাকে বেহেশত থেকে বিতাড়িত করা হলো সারাজীবনের জন্য। ছয় হাজার বছর ধরেও ইবাদত করার ফল সে পেলো বিতাড়িত আর পথভ্রষ্ট হয়ে। কেন সে এই ফল পেলো? শুধুমাত্র অহংকারের জন্য। ইতিহাস স্বাক্ষী ,আপনার জ্ঞানের পরিধি যত বাড়বে, ততই আপনি বিনয়ী হবেন, ততই আপনি আল্লাহকে ভয় করে তার আদেশ নিষেধ মেনে চলার দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাবেন। যখনি জ্ঞান অর্জনের অহংকার আপনার মধ্যে জন্ম দিবে, তখন থেকেই আপনি আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া শুরু করবেন এবং পথভ্রষ্ট হবেন।
হাদিসে আছে,
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এমন কোনো ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে না, যার অন্তরে শস্যদানা পরিমাণ ঈমান থাকবে এবং এমন কোনো ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অন্তরে শস্যদানা পরিমাণ অহংকার থাকবে। ’ –সহিহ মুসলিম শরীফ: ১/৬৫
সুতরাং আপনি যত বড় জাননেওয়ালাই হোন না কেন, নিজের মনকে কখনো কলুষিত করবেন না, কাউকে অবহেলা করবেন না, ছোট ভাববেন না কাউকে, আর অহংকার তিল পরিমান ও ঠাঁই দিবেন না আপনার অন্তরে।
পরিশেষে,
আমাদের সমাজে বতমানে সেই স্তরের লোকজন বেশী, যারা অল্প একটু পড়াশোনা করেই অহঙ্কারী হয়ে ওঠে দিনদিন , ধরা কে করে কে সরা জ্ঞান। কথায় আছে অল্প পানির মাছ লাফায় বেশী। আসলেই তাই, আপনার আশেপাশে এরকম পণ্ডিত কেউ যদি থাকে অযথাই যে নিজের পান্ডিত্য জাহির করে বেরায়, বুঝে নিবেন সেও অল্প পানির মাছ তাই বেশি লাফাচ্ছে
এই অল্প বিদ্যা ভয়ংকর কেন বলা হয় জানেন? সে অল্প জানে বা পুরোপুরি জানেনা এজন্য? না কেবলি এজন্য না। অল্প বিদ্যা নিয়েও সে যে নিজেকে মহাজ্ঞানী মনে করে এটাই মুল সমস্যা। এরকম মানুষ যা জানে, যদি ভুলভাল ও জানে,নিজের জানায় স্থির বসে থাকবে। বাহির থেকে আমি আপনি কেউই তাকে এই উপলব্ধিটুকু দিতে পারবোনা যে তুমি ভুল জানো। বিশেষ করে আমাদের দেশে এধরণের মানুষের অভাব নেই। জানে দু আনার, ভাব নেয় দশ আনার। আবার কথায় কথায় বলবে, আমার চেয়ে তুমি বেশী জানো?
ভাইরে সত্যিকারের দীক্ষায় দীক্ষিত ব্যক্তি কখনো বলবে না, আমার চেয়ে তুমি বেশী জানো, বরংচ কেউ যদি তাকে এরুপ মন্তব্য করে, সে কোনরূপ তর্কে বিতর্কে না গিয়ে চুপচাপ থাকবে।
কথায় আছে-
খালি কলস বাজে বেশী। অপরদিকে কলসে পানির পরিমান যত বাড়তে থাকবে, আপনি বাহির থেকে যতই শব্দ করেন এমন মিনমিনে এক আওয়াজ আসবে যা আপনার নিজের কান অবদিই পৌছুবে না।
অল্প জানা ব্যক্তি হলেন খালি কলসের মতন। কথায় কথায় ছনাৎ ছনাৎ করে বাজে।কলসির পানি হলো জ্ঞানের পরিমাণ আর কলস হলো জ্ঞানি ব্যক্তি। এই পানি যত বাড়বে, মানে জ্ঞান যত বাড়বে কলস মানে জ্ঞানী ব্যক্তির আওয়াজ মানে ঠাট বাঁট ততই কমতে থাকবে।
যেখানে জ্ঞানপাপী মানুষের ঠাটে বাঁটে আপনি দাড়াতেই পারবেন না, সেখানে একজন প্রকৃত জ্ঞানীব্যক্তি আপনাকে দিবে আপনার উপযুক্ত সম্মান,আপনার মতামতের মূল্য দিবে এবং প্রয়োজনে আপনার কাছ থেকেও পরামর্শ গ্রহণ করবে। মনে রাখবেন,জ্ঞানের প্রথম স্তরে প্রবেশকারী হয় শিক্ষিত, আর শেষস্তরে প্রবেশকারী হয় জ্ঞানী।
যাই হোক, এবার বুঝলেন তো 'ঝিনুকে মুক্তো হলে চুপ হয়ে যায়,মুখ খোলে না' এটার ভাবার্থ কত গভীরে যেয়ে ঠেকেছে?
আমার কয়েক'টা আটিক্যালের লিংক, এখানে ক্লিক করেই পড়তে পারেন-
ফিনিক্স পাখি: রুপকথায়- আগুনে জন্ম যে পাখির
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এক মুসলিম উপজাতীয় সম্প্রদায়ের কথা
জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি: সুফিবাদ এবং জীবন বদলে দেয়া ১০ উক্তি
আপনার মৃত বাবা- মা’র জন্য আপনিই দোয়া করুন- কি কি দোয়া ও আমল করবেন? শুনতে কি পাও? |