পুরান ঢাকা:স্মৃতির চাদরে মোড়া-কি নেই এখানে?
আজকে আমরা কথা বলবো আমাদের এই প্রিয় ঢাকার আদি অঞ্চলটিকে নিয়ে যেটাকে আমরা সবাই পুরান ঢাকা নামে জানি। সংস্কৃতি নির্ভর আমাদের বাংলাদেশের অন্যান্য যে কোন অঞ্চল থেকে আমাদের এই পুরান ঢাকার রয়েছে অনেকটুকু ভিন্ন এবং চরম উপভোগ্য আলাদা এক সংস্কৃতি।
পুরান ঢাকার ইতিহাস কিন্তু অনেক পুরানো এবং অনেক অভিজাত্যে ভরপুর ছিলো। বিশেষ করে মোঘল আমলে পুরান ঢাকা অন্যতম এক সুন্দর, সুপরিকল্পিত এবং উপভোগের এক শহর ছিলো।
কালের বিবর্তনে মোঘলরা আজ আর নেই তবে মুঘল প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে একসময়ের প্রচণ্ড ঝাকঝমকপুর্ন প্রাচীন এই শহরে রয়ে গেছে মোঘল দের বিভিন্ন আচার-ঐতিহ্য, দালান কোঠা, রীতি রেওয়াজ, নিয়ম কানুন ইত্যাদি।
পুরান ঢাকার ইতিহাসঃ
৩৫০ শতক থেকে ১৬১০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন শাসনামল( কামরুপ সাম্রাজ্য, হিন্দু শাসনামল,দিল্লী সালতানাত শাসনামল) পর্যায়ক্রমে শেষ করার পরে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম খান চিশতী কর্তৃক আদি ঢাকার যাত্রা শুরু হয়। মুলত মুসা খাঁ ( বারো ভূইয়া জমিদারির শেষ জমিদার) এর পতনের পরেই মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে শুরু হয় প্রাচীন ঢাকার ঐতিহাসিক যাত্রা।
পুরান ঢাকার ইতিহাস খুঁজে তথ্য যা পেলাম, খুবই ইন্টেরেস্টিং এবং চমকপ্রদ মনে হলো। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে জুড়ে গড়ে উঠা এই প্রাচীন নগরীর নামকরণে কিছুটা দ্বিমত রয়েছে। যেমন অনেকে মনে করেন আদি ঢাকার নামকরন করেছেন রাজা বল্লাল সেন। কোন এক সময় বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী জঙ্গলে ঘুরতে যেয়ে তিনি দেবী দুর্গার এক পুরাতন বিগ্রহ খুঁজে পান।
পরবর্তীতে এই বিগ্রহ প্রতিস্থাপন এর জন্য তিনি ঢাকেশ্বরী মন্দির স্থাপন করেন। দেবী দুর্গার বিগ্রহ টি যেহেতু ঢাকা ( গুপ্ত) অবস্থায় তিনি পেয়েছিলেন তাই তিনি মন্দিরের নামকরণ এভাবে করেন। পরবর্তীতে মন্দিরের এই ঢাকেশ্বরী নাম থেকেই কালক্রমে মন্দির এবং তার আশেপাশের বেশ কিছু অঞ্চল ঢাকা নামে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে রটে যায়।
আরেকদল মনে করেন, সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১০ সালে ততকালীন ঢাকাকে বাংলাদেশ এবং ভারতের বেশ কিছুঅঞ্চলের রাজধানী হিসেবে ঘোষিত করেন। তখন ঢাকার এ আদি অঞ্চলে সুবাদার ইসলাম খান এই আনন্দে প্রচুর ঢাক বাজানোর আদেশ করেন।
লোকমুখে শোনা যায়, এই ঢাক বাজানোর ঘটনা এতোই চমকপ্রদ ছিলো যে আস্তে আস্তে লোকমুখে সেটা এক কিংবদন্তি গল্প হিসেবে প্রচলিত হতে হতে একসময় এই শহরটির নাম ঢাকা হয়ে যায়। তবে প্রাচীন ঢাকার প্রাচীন নাম কিন্তু ঢাকা ছিলো না। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর কে সম্মান প্রদর্শন পুর্বক কিছু সময় এর নাম ছিলো জাহাঙ্গীরনগর।
পুরানো ঢাকার নামকরণের শেষ মতবাদ টি হলো এর ভৌগোলিক অবস্থানের সাথে সম্পর্কিত। ১৬১০ সালে সুবাহ বাংলার রাজধানী যখন রাজমহল থেকে স্থানান্তরিত করে পুরান ঢাকায় নেওয়া হয়, এই ঢাকার ভৌগোলিক অবস্থান নির্ধারণের জন্য সুবেদার ইসলাম খান চিশতী এক অদ্ভুত নির্দেশ দেন।
তার নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকার সীমানা নির্ধারণের উদ্দেশ্য বেশ কয়েকজন ঢাকি কে উচ্চস্বরে ঢাক বাজাতে থাকেন। পাশাপাশি তিনজন ঘোরসওয়ার ছুঁটে যান তিন দিকে। বলা বাহুল্য যে পর্যন্ত এই ঘোড়সওয়ার রা ঢাকের শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন, সেখানেই ঢাকার সীমানার নিশানা গেড়ে আসেন। তো এই ঢাকের শব্দ ওইসময় এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিলো, লোকমুখে প্রচলিত হতে হতে একসময় পুরোটা অঞ্চল ঢাকা নামেই পরিচিত হয়ে যায়।
বর্তমানের পুরান ঢাকাঃ
কালের অতল গহবরে হারিয়ে যাওয়া মোঘল দের সেই ঢাকা এখন বিস্তর পরিবর্তিত। আধুনিক পুরান ঢাকা এখন আরো পরিমার্জিত, সুগঠিত এবং আধুনিক কলা কুশলীতে সুসজ্জিত।
এখনকার পুরান ঢাকার আদি কিছু বাসিন্দা যদিও উর্দুতে কথা বলেন, কিন্তু সমগ্র পুরান ঢাকায় এখন ঢাকাইয়া ভাষা প্রচলিত। ঢাকাইয়া কুট্টি নামে পরিচিত পুরান ঢাকার মানুষেরা খুবই আমোদপ্রিয় এবং বেশ ভোজনরসিক।
এই পুরান ঢাকায় মোঘলরা এখন কেবল আর দালান কোঠাতেই তাদের অস্তিত্ব প্রকাশ করেন না। মূলত পুরান ঢাকার ভোজনবিলাস খুবই শক্তপোক্ত ভাবে মোঘল বেশভূষা এখনো ধরে রেখেছে। পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে বিভিন্ন স্বাদের খাবার দোকান, যে কোন পালা পার্বণে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী মোঘল খাবার এখনো মোঘলদের কথা আমাদের এতটুকুও ভুলতে দেয়নি।
বিশ্বায়নের এ সময়ে পুরান ঢাকাতেও লেগেছে আধুনিক শিল্পায়নের ছোয়া। সুন্দর সুন্দর উঁচু-নীচু আধুনিক বিল্ডিং, শপিং মল, আধুনিক যাতায়াত ব্যবস্থা, ছোট বড় নানারকম কলকারখানার সমাবেশ এই ঢাকাকে করেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক শিল্প অঞ্চল।
সেই আদিকাল থেকে এখন অবধি আমাদের এই পুরান ঢাকা সবসময়েই বাণিজ্যিক দিক দিয়ে বিশ্বের দরবারে সমান গুরুত্বের এবং সমান সুপ্রসিদ্ধের শহর হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে।
পুরান ঢাকার দর্শনীয় স্থানগুলোঃ
পুরান ঢাকার দর্শনীয় স্থানগুলোর বেশির ভাগই বিভিন্ন বিশেষ মোঘল স্থাপনা। অনেকেই হয়তো জানেইনা শুধুমাত্র পুরান ঢাকার এইসব স্থাপনা দেখার জন্য দেশ বিদেশের কত শত পর্যটক বাংলাদেশে ছুঁটে আসেন।
যাই হোক প্রিয় পাঠক মোটামুটি একটা লিস্ট আপনাদেরকে দিয়ে দিচ্ছি। আশা করছি লিস্টের প্রতিটি দর্শনীয় স্থানে একবার হলেও স্বপরিবারে ঘুরে আসবেন।
• ঢাকেশ্বরীর মন্দির।
• লালবাগের কেল্লা।
• সদরঘাট।
• আহসান মঞ্জিল।
• হোসেনী দালান।
• শাঁখারীবাজার।
• চকবাজার।
• রানি ভিক্টোরিয়া অথবা বাহাদুর শাহ পার্ক।
• মিটফোর্ড হসপিটাল।
• তারা মসজিদ।
• বড় কাটারা।
• ছোট কাটারা।
• জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
• আর্মেনিয়ান গির্জা।
• লালকুঠি( নর্থব্রুক হল)
• বিভিন্ন প্রসিদ্ধ মসজিদ( বেগমবাজার মসজিদ, খান মুহাম্মাদ মসজিদ, বিনত বিবির মসজিদ, শায়েস্তা খান জামে মসজিদ, তারা মসজিদ)
• ইডেন কলেজ।
• কার্যন হল।
• স্বামীবাগ মন্দির।
• রমনা কালী মন্দির।
• হলি রোজারিও চার্চ।
• বঙ্গভবন।
• পুরাতন হাই কোর্ট ভবন।
• সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।
পুরান ঢাকার খাবারঃ
ঢাকাইয়া খাবারের একবার যে খেয়েছে, কোনদিন ও ভুলতে পারবেনা এর মজাদার স্বাদ। মূলত মোঘলরাই পুরান ঢাকার খাবারের এক আমুল পরিবর্তন এনেছে যা এতোদিন পরেও পুরান ঢাকার খাদ্যাভ্যাসে বর্তমান।
বরংচ দিন যত যাচ্ছে,পুরান ঢাকার খাবারের স্বাদ যেন বেড়েই চলেছে। পুরান ঢাকার প্রসিদ্ধ কিছু খাবারের মধ্যে রয়েছে-
• মোরগ পোলাও।
• কাচ্চি এবং পাক্কি বিরিয়ানি।
• বাকরখানি।
• মোঘলাই পরোটা।
• নান রুটি।
• মিষ্টি এবং ঝাল পরোটা।
• বোরহানি।
• লাবান।
• নেহারী।
• বিভিন্নধরনের কাবাব ( শাম্মী কাবাব, বটি কাবাব, ঝালি কাবাব, নার্গিস কাবাব,শাহী কাবাব, শিক কাবাব, টিকিয়া)।
• কোরমা।
• রেজালা।
• দই বড়া।
• নান্নার অথবা হাজীর বিরিয়ানি।
• মুরগী মসল্লাম।
• লাচ্ছি।
• বিভিন্ন ধরনের শরবত ( পেস্তা বাদামের শরবত অন্যতম)।
পুরান ঢাকার উৎসবসমুহঃ
পুরো বাংলাদেশের যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানের চেয়ে পুরান ঢাকার উৎসব গুলো আরো মহাসমারোহ এবং ঘটা করে পালন করা হয়। ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও আরো কিছু অনুষ্ঠান পুরান ঢাকায় পালিত হয়।
• ঈদুল ফিতর।
• ঈদুল আযহা।
• শবে বরাত।
• পহেলা বৈশাখ।( বাংলা নববর্ষ)
• সাকরাইন বা ঘুড়ি উৎসব।( পৌষ সংক্রান্তি)
• মহররম বা আশুরা।( শিয়া ধর্মীয় অনুসারীরা পালন করেন)
এছাড়া অন্যান্য ঘরোয়া অথবা সামাজিক যে কোন অনুষ্ঠান পুরান ঢাকায় বেশ ঘটা করে পালন করা হয়।
বায়ান্নো বাজার তেপ্পান্নো গলির ঢাকা শহরঃ
এই অদ্ভুত এবং প্রাচুর্যমন্ডিত নামটির সঠিক ইতিহাস আসলে কোথাও খুঁজে পেলাম না। পুরান ঢাকাকে অনেকেই বায়ান্নো বাজার তেপ্পান্নোর গলির শহর বলে। এর কারন হিসেবে ঢাকা শহরের অগণিত গলি, পাড়ার মোড়ে মোড়ে বাজার ইত্যাদি হতে পারে।
শুধু বাজার কিংবা গলি নয়, ঢাকা শহরে রয়েছে অসংখ্য মসজিদ। এজন্য ঢাকাকে মসজিদের শহর ও বলা হয়।
প্রায় ৪০০ বছরের বেশী পুরানো এই শহরের রয়েছে আরো বেশকিছু অতুলনীয় অঞ্চলভিত্তিক নাম, পুর/তলা/তলী/গঞ্জ ইত্যাদি সেইসব নামের শেষে সংযুক্ত হয়ে নামগুলোর সৌন্দর্য আরো যেন বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।
পরিশেষে,
মোঘলদের পত্তনের পরে ব্রিটিশ লর্ডেরা এই পুরান ঢাকা শহরের বেশকিছু সংস্কার করায় ব্রিটিশ শাসনকাল পর্যন্ত এই শহরের শ্রী কিছুটা বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু আধুনিকায়নের যাতাকলে পিস্ট হয়ে আমাদের সেই প্রাচীন অভিজাত এবং ছিমছাম ঢাকা শহর অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে তার পূর্বের প্রাচীন সৌন্দর্য। বর্তমানে নগরপিতাদের অবহেলা আর অযত্নে এই শহর যেন কেমন বিবর্ণ আর মলিন হয়ে যাচ্ছে।
যাই হোক,সর্বোপরিভাবে আমাদের পুরান ঢাকা এখনো রিপ্রেজেন্ট করে আমাদের প্রাচীন অনেক ঐতিহ্য এবং গৌরবমন্ডিত ইতিহাস।
ইতিহাসের চাদরে মোড়ানো আমাদের এই পুরান ঢাকা।
কি নেই এখানে? শিক্ষা সংস্কৃতি, বিভিন্ন কলকারখানা, অফিস আদালত, আচার-অনুষ্ঠান, বাহারী চালচলন, মুখরোচক খাবার দাবার, ঘুরতে যাওয়ার জন্য অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা, আরো কত কি আছে এখানে!
আমাদের ভালোবাসার আদরে মোড়া প্রাচীন এই আমাদের পুরান ঢাকা কেবলি এক শহর নয়, এ এক অন্য রকম আবেগ, অন্যরকম শান্তির স্থান।
সূত্রঃ উইকিপিডিয়া। রোর মিডিয়া।