বন্ধুত্ব: ভালবাসা আর মায়ায় ভরা যে সম্পর্ক
“Some people go to priests; others to poetry; I to my friends” – বিখ্যাত ইংলিশ লেখিকা Virginia Woolf এর এই উক্তি থেকে বন্ধুত্বের ব্যাপ্তি অনুমান করা যায়। বন্ধুত্ব এমনই এক বিশাল আশ্রয় যেটা বটবৃক্ষের মতো আগলে রাখে সবাইকে। বন্ধুত্ব নামের বিশাল নীল আকাশের মাঝে সবাই যেন নিরাপরে উড়ে বেরানো মুক্ত পাখির ঝাঁক।
বন্ধুত্ব শব্দটি খুব ছোট হলেও অনেক গভীর একটা অর্থ বহন করে। বন্ধুত্ব মানে কি শুধুই বন্ধু-আড্ডা-গান? মোটেও না .. বন্ধুত্ব মানে বাবার শাসন, মায়ের আদর, মনোবিজ্ঞানীর কাউন্সিলিং, দেনাদার পাওনাদারের মতো ঝগড়াঝাঁটি তারপর আবার প্রানখুলে হাসা।
বন্ধুত্বের সংজ্ঞা কি? আসলে বন্ধুত্বের কোন সংজ্ঞা নেই। কোন বিশেষণ বা সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত কর মড়কবন্দি না করে রাখার মতো কোন সম্পর্ক যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে এই বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের কোন সংজ্ঞা নেই বলেই, কোন সীমারেখায় এটাকে আটকে রাখা যায় না বলেই বন্ধুত্ব এতো বিশাল একটা ব্যাপার।
“বন্ধু ছাড়া লাইফ ইমপসিবল” - এরকম একটা কথা প্রায়ই আমরা শুনে থাকি। শুনে মনে হতে পারে এটা আবার কেমন কথা? বন্ধু ছাড়া লাইফ আবার ইমপসিবল হয় কিভাবে !!! কিন্তু একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে কথাটা পুরোপুরি সত্য। ক্ষুদ্র এ জীবনে বেঁচে থাকার প্রেরণা সেটা তো পাওয়া যায় বন্ধুর কাছ থেকেই। সকল সম্পর্কের মাঝে একটা দেয়াল থাকে, সকল সম্পর্কের মাঝে হয়তো কিছুটা লুকোছাপাও থাকে কিন্তু বন্ধুত্বের মাঝে থাকে না কোন পর্দা। স্বচ্ছ পানির মতোই পরিস্কার এই সম্পর্ক। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে ফিরে বন্ধুর কাছেই ফিরে যেতে হয়। বন্ধুরাই এগিয়ে আসে সকল প্রয়োজনে, নিঃস্বার্থভাবে সবার আগে।
আসুন বন্ধুহীন একটা জীবনের কথা কল্পনা করা যাক। চোখ বুঝে একটু কল্পনা করুন যে আপনার কোন বন্ধু নেই। কোন বিষয় নিয়ে প্রচুর মন খারাপ কিন্তু মন ভালো করে দেবার জন্য হাসি তামাশা করার মতো কোন বন্ধু নেই আপনার। প্রচন্ড ডিপ্রেশন তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে আপনাকে, নিজের মাঝে নিজেকে গুঁটিয়ে ফেলছেন ক্রমশ। এই অবস্থা থেকে আপনাকে টেনে তুলে আনার জন্য হাত বাড়িয়ে দেবার মতো কোন বন্ধু নেই। হয়তো খুব অর্থকষ্টে দিন যাপন করছেন। লজ্জায় কারো কাছে চাইতেও পারছেন না। এমন সময় হয়তো একটা বন্ধুর অভাব খুব অনুভব করছেন যার কাছে নিঃসঙ্কোচে গিয়ে অধিকারের সুরে বলতে পারবেন-“দোস্ত, মানিব্যাগে যতো টাকা আছে বাইর কর”।
অনেকক্ষণ তো চোখ বন্ধ করে বন্ধুহীন একটা জীবন কল্পনা করলেন। এবার চোখ খুলে তাকান। চিন্তা করে দেখুন তো বন্ধু ছাড়া যে জীবনের কথা কল্পনা করলেন সেটা কি আদৌ কোন জীবন ছিল ? এমন কোন জীবন ভুলেও চাইবেন না আপনি। সব সময় বন্ধুদের নিয়ে মেতে থাকার মতো একটা জীবন সবার কাম্য যেখানে সুখে-দুঃখে সব অবস্থায় বন্ধুরা ছায়াসঙ্গির মতো পাশে থাকবে।
তবে কে ভালো বন্ধু, কার সাথে বন্ধুত্বটা জমবে, নির্ণয় করার কোন উপায় আছে কি ? কখন বুঝবেন কেউ একজন আপনার বন্ধু হয়ে উঠেছে বা বন্ধুত্ব টাইটেলে কখন একটা সম্পর্ককে বিশেষায়িত করা যেতে পারে !!! এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো এই একটা উক্তির মধ্য দিয়ে খুব সহজেই ব্যাখা করে দেয়া যায়। বলা হয়ে তাহকে-“True friendship comes when the silence between two people is comfortable”। অর্থাৎ বন্ধুত্ব সেটাই, যেখানে যোগাযোগের জন্য কথা বলাটা একেবারেই আবশ্যক নয়। আমার যখন কথা বলি তখন একে অপরের সাথে কথা বলায় ব্যাস্ত হয়ে যায়। চুপ চাপ থাকলে অপর মানুষটি আবার কি ভাববে এটা ভেবে কতো মেকি কথা বলায় ব্যাস্ত হই আমরা, কিন্তু বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এই বাধ্যবাধকতা নেই। কোন মিছে লোক দেখানো সামাজিকতার ধার ধারে না বন্ধুত্ব। কোন কথা না বলে চুপচাপ যাদের সাথে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা তারাই তো বন্ধু। নীরবতার ভাষাতেই কথা হবে বন্ধুর সাথে। বন্ধুত্ব এতোটাই শক্তিশালী। এ জন্যই তো বলা হয় বন্ধুত্বের কোন ভাষা নেই। বন্ধুত্বের ভাষা কখনো অনেক কোলাহলপূর্ণ আবার কখনো একেবারেই নীরব-নিস্তব্দ।
বন্ধুত্ব সম্পর্কের সবচেয়ে মূল বিশিষ্ট্য হচ্ছে, কোন রকম ফরম্যাট বা সিস্টেম পালন করে বন্ধু নামক উপাধি পেতে হয় না। পরিবার বা সংসার এসবের মধ্যে যে Formal Structure থাকে সেটা বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে কোন প্রয়োজন হয় না। পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ না করে থাকা সম্ভব না। এটা তারা মেনে নিবে না। যদি কোন কারনে পরিবারের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তাহলে সেটা সম্পর্কের ফাটল ধরাবে একটা সময়। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন এক্ষেত্রে বন্ধুত্ব কতোটা স্বাধীন। মাসের পর মাস কোন রকম যোগাযোগ না করেও টিকে থাকে বন্ধুত্ব। দীর্ঘদিন পর যখন বন্ধুর সাথে দেখা হয় তখন মনের ভেতরের আবেগ আর মুখের হাসি জানিয়ে দেয় কতো পবিত্র আর বাঁধাধরাহীন একটা সম্পর্কের নাম-বন্ধু। যদিও নেহাৎ সমস্যায় না পড়লে বন্ধুকে দেখা দেয়ায় সুযোগ কেউ হাত ছাড়া করে না।
বন্ধুত্বের রঙ কেমন হতে পারে এটা নিয়েও অনেকেই অনেক কিছু বলে থাকে। একটা নির্দিষ্ট রঙের আল্পনায় বন্ধুত্বকে আটকে ফেলা সম্ভব নয়। বন্ধুত্ব কখনো বেদনার নীল রঙ, কখনো ভালোবাসার লাল রঙ। প্রকৃতির সজীবতার মতো বন্ধুত্ব কখনো সতেজ সবুজ আবার কখনো শান্ত ধূসরের মতো অবুঝ। তুষার শুভ্র সাদার মতোই পবিত্র কিংবা অন্ধকারের মতো রহস্যময়তার নামই যেন বন্ধুত্ব। তাই আসলে বন্ধুত্বের নির্দিষ্ট কোন রঙ নেই। সকল রঙের মাঝেই যেন রয়েছে বন্ধুত্বের বৈশিষ্ট্য।
বন্ধুত্ব আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা। জীবন যদি হয় একটি রেলগাড়ি তাহলে সেটার ইঞ্জিন হচ্ছে বন্ধুত্ব। যে কথা পৃথিবীর কাউকে বলা যায় না এমনকি নিজের মা -বাবা কারো সাথেই শেয়ার করা যায় না সেটা অবলীলায় বলে দেয়া যায় বন্ধুর কাছে। চেপে রাখা কষ্ট বন্ধুর কাছে বলে নিজেকে হালকা করা যায়। কর্মব্যাস্ত একটা সপ্তাহ শেষে বন্ধুদের সাথে খানিক আড্ডা ভুলিয়ে দেয় সারা সপ্তাহের কাজের সব চাপ। জীবনের কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পরামর্শদাতা হিসেবে সবচাইতে ভরসার জায়গা হচ্ছে বন্ধুরা। বন্ধু এমনই এক অদ্ভুত জিনিস যে আপনার দুঃখে কাঁদবে আবার আপনার সুখে হাসবে।
মনে হতে পারে বন্ধুত্ব মানেই সিরিয়াস ব্যাপার স্যাপার। মোটেও নয় … বন্ধু মানেই ফান। আড্ডার সার্কেলে এক বন্ধু অপর বন্ধুকে নিয়ে ফান করতে করতেই সময় শেষ। আপনার খুব বিপদের মুহূর্তে সবার আগে আপনাকে নিয়ে মজা নিবে যে মানুষটি সে হচ্ছে আপনার কাছের বন্ধু আবার সবার আগে সেই বিপদ থেকে মুক্ত করতেও এগিয়ে আসবে সেই বন্ধুই। বন্ধুত্ব আসলে খুব সিরিয়াস একটা সম্পর্ক কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে এটার কার্যক্রমে সিরিয়াস টাইপ কোন বিষয় নেই। তর্ক-আড্ডা,গল্প-গান, মান-অভিমান, সুখ-দুঃখ, একে অপরকে ট্রল করা এসবের মধ্যে দিয়েই বন্ধুত্বের বন্ধন নিবিড় হতে থাকে।
জগতের সব কিছু পুরনো হয়। বয়সের ফ্রেমে আটকে যায় সব কিছু। বার্ধক্য হানা দেয় সর্বত্র। কিন্তু বন্ধুত্ব এক আশ্চর্য চিরতরুণ অধ্যায় যেটা সময়ের সাথে সাথে হয়ে উঠে আরো তারুণ্যময়। শিরা-উপশিরা ভেদ করে শরীরে যখন বার্ধক্য যখন ভর করে বন্ধুত্বের তখনো যৌবন যেন। বন্ধুত্ব কখনো বুড়িয়ে যায় না, বরং এটি মনের বুড়োত্বকে দূর করে দেয়। এ জন্যই বন্ধু হচ্ছে মানুষের জীবনের মেডিসিন।
বন্ধুত্ব যে কখন কার সাথে হয়ে যায় বলা যায় না। বলে কয়ে বন্ধু সৃষ্টি হয় না। জীবনের যে কোন সময়ই আপনি খোঁজ পেতে পারেন নতুন বন্ধুর। জীবনের সকল বাঁকে বাঁকে কোন না কোন বন্ধু অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। বন্ধুত্বের প্রসারিত হাত বাড়িয়ে দিন, দেখবেন সেই হাতে ধরে আপনার সাথে এগিয়ে চলছে বন্ধুদের দল।
Shawshank Redemption এর দুই ভিন্ন মানসিকতার, ভিন্ন বয়সের মানুষের মতোই বন্ধুত্ব টিকে থাকুক আজীবন। সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো জীবনের শেষ দৃশ্যেও যেন কোন এক সাগর পাড়ে কোন এক বন্ধু আপনার অপেক্ষায় থাকে। বন্ধুর কাছে আপনিও ছুটটে থাকবেন আর আপনার মনে মনলোগে বলতে থাকবেন – “I hope to see my friend and shake his hand”
আমার কয়েক'টা আটিক্যালের লিংক, এখানে ক্লিক করেই পড়তে পারেন-
কি ভাবে আপনার সন্তানের সাথে সেক্স নিয়ে কথা বলবেন?
পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে, কিন্তুএকটাও খারাপ বাবা নেই, কেন?