জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি: সুফিবাদ এবং জীবন বদলে দেয়া ১০ উক্তি
সুফি সাধক জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি (১২০৭ – ১৭ ডিসেম্বর ১২৭৩) তেরশ শতকের একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি ছিলেন একজন বরেণ্য কবি, আইনজ্ঞ, ধর্মতাত্ত্বিক, এবং অতীন্দ্রিবাদী। এই সুফি সাধকের প্রভাব দেশ, জাতি, বর্ণ, ধর্ম ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পরেছে সারা বিশ্বব্যাপী। বর্তমানে মাওলানা রুমীকে বলা হয় আমেরিকার বেস্ট সেলিং পোয়েট। এর দ্বারাই বোঝা যায় ৮০০ বছর আগের পারস্যের একজন মুসলিম কবির বিশ্বব্যাপী প্রভাব। এই বরেণ্য সুফি সাধক ও তার আধ্যাত্মিক জ্ঞানগর্ভ সাহিত্য কর্ম থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য আমাদের আগে জানা প্রয়োজন ইসলাম, সুফিবাদ ও তার জীবনী।
ইসলাম, সুফিবাদ ও এর উৎস
ইসলাম ধর্মে সুফিবাদ বা তাসাউফ হচ্ছে একটি আধ্যাত্মিক দর্শন। সদা সর্বদা মহান আল্লাহ তায়ালার জিকিরের মাধ্যমে কল্বকে কলুষমুক্ত করে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হচ্ছে এই দর্শনের মুল ভিত্তি। বর্তমান সুফিবাদের সাথে মূল ধারার ইসলাম ধর্মের কিছু বিরোধপূর্ণ ও সাংঘর্ষিক বিষয় থাকলেও, এই মতবাদকে ইসলাম ধর্মের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
সুফিবাদ মূলত ইসলামের মৌলিক কোন বিষয় নয়। সুফিবাদ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে নানা জনের নানা মত। সুফিবাদ শব্দটি মূলত আরবি শব্দ সুফ থেকে এসেছে। সুফ এর আভিধানিক অর্থ পশম। পশম দ্বারা তৈরিকৃত বস্ত্র পরিধান আড়ম্বরহীনতার প্রতীক। তৎকালীন সময়ে এই দর্শনের অনুসারীরা সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের জন্য সকল জাগতিক ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হন। তখন পশমী বস্রই ছিলো তাদের সাধারণ পোশাক। আর এখান থেকেই এসেছে সুফিবাদ শব্দটি। এছাড়া আরেকটি মত প্রচলিত রয়েছে। সাফা শব্দের অর্থ হচ্ছে পবিত্র। সাফ অর্থাৎ পবিত্রতা বা পবিত্রতা লাভ করা। আর এর দর্শনের মূলভিত্তি হলো অন্তরকে পবিত্র করে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। তাই বলা যায় এই সাফা শব্দ থেকেও সুফিবাদ শব্দের উৎপত্তি হতে পারে। সুফি সাধক আল রুধাবারি এই দুইটি মতকে একত্রিত করে বলেছেন, "সুফি হলেন সে ব্যক্তি যিনি সর্বোচ্চ পরিশুদ্ধ অবস্থায় পশমী বস্ত্র পরিধান করেন।"
সুফিবাদের উৎপত্তি স্থল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু এটি সর্বজন স্বীকৃত যে সুফিবাদ বিস্তার লাভ করে পারস্যে। পারস্যের প্রখ্যাত সুফি সাধকেরা বিভিন্ন কাব্য, শাস্র, ও পুস্তক রচনার মধ্যমে সাধারণ জনগণের নিকট সুফিবাদ জনপ্রিয় করে তোলেন। এর পরে সেখান থেকে এই আধ্যাত্মিক দর্শন সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পরে। এমনকি ভারত উপমহাদেশেও ইসলামের আগমন ঘটে সুফিদের হাত ধরে।
এই আধ্যাত্মিক দর্শন, যেসকল বরেণ্য সুফি সাধকদের মাধ্যমে সারা বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে, তাদের মধ্যে নিজের সৃষ্টি দ্বারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ সর্বোপরি সকলের মন জয় করে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত হয়েছেন এমন সংখ্যা খুব বেশী নয়। এসকল বরেণ্য সাধকদের মধ্যে মাওালনা জালাল উদ্দিন রুমী অন্যতম।
জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি ও সুফিবাদ
ইসলাম ধর্মের আধ্যাত্মিক দর্শন “সুফিবাদ” এর কথা আসলে যে বরেণ্য ব্যক্তির নামটি সর্বপ্রথম আসবে, তিনি হলেন পারস্যের সুফি ও মুসলিম কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী। রুমি আধ্যাত্মিক সাধনার পাশাপাশি তার জীবন ঘনিষ্ঠ সাহিত্য কর্মের জন্য অমর হয়ে রয়েছেন। তিনি ১২০৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন এবং এবং ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করেন। এই বরেণ্য সুফি সাধক জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ বালখী, মাওলানা রুমি, মৌলভি রুমি নামেও পরিচিত। তবে শুধু রুমি নামে বেশী জনপ্রিয়।
মাওলানা রুমি তৎকালীন বালখে (বর্তমানে আফগানিস্থান) জন্মগ্রহন করেন। তখন বালখ ছিলো সুফীবাদ চর্চার মূল কেন্দ্রবিন্দু। তার পিতা বাহা উদ্দিন ওয়ালাদ ছিলেন তখনকার একজন প্রসিদ্ধ ধর্মতাত্বিক। ছোটবেলা থেকেই রুমি তার বাবার কাছ থেকে প্রভাবিত হয়ে এই দর্শন চর্চা শুরু করেছেন। তখনকার ফার্সি কবি আত্তার ও সানাইও তার উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছেন।
রুমীর মধ্যবয়সে পরিচয় হয় আরেক সুফি সাধক দরবেশ শামস তাবরিজির সঙ্গে, এবং তখন থেকেই তার জীবন সম্পূর্ণ বদলে যায়। তার সাথে পরিচয় হওয়ার পর রুমী তার শিষ্যত্ব গ্রহন করেন এবং সুফি সাধনায় মননিবেশ করেন। এক রাতে মাওলানা রুমী ও শামস দুইজনে কথাবলাকালীন কেউ শামসকে ডাক দেয় এবং সেই ডাকে শামস সারা দিয়ে বের হওয়ার পর আর কখনও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে একসাথে থাকাকালীন শামস তাবরিজি রুমীর জীবনে সবচেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তার করেছেন। পরবর্তীতে বহুদিন শামস তাবরিজি এর খোঁজ পাওয়া না গেলে মাওলানা রুমী তাকে মৃত ঘোষনা করেন এবং তার মৃত্যুর শোক প্রকাশে রচনা করেন “দেওয়ান-এ শামস-এ তাবরিজী” কাব্যগ্রন্থ। শামসকে খোজার এক পর্যায়ে তিনি লিখেছেন,
“আমি কেন তাকে খুঁজব?
সে আর আমি তো একই
তাঁর অস্তিত্ব আমার মাঝে বিরাজ করে
আমি নিজেকেই খুঁজছি!”
সুফি সাধক রুমির অধিকাংশ সাহিত্যকর্মই ফার্সি ভাষায় রচিত হলেও, তিনি তুর্কি, আরবি ও গ্রীক ভাষায়ও পারদর্শীতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার রচিত মসনবী কাব্যগ্রন্থ ফার্সি ভাষার শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মাওলানা রুমির সাহিত্যকর্ম প্রভাবিত করেছে ফার্সী, তুর্কী, হিন্দী, উর্দু এমনকি বাংলা সাহিত্যকেও। তার রচিত কাব্যগ্রন্থগুলোর বিভিন্ন ভাষার অনুদিত হয়েছে এবং এগুলোও ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয় হয়েছে। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমিকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিত কবি এবং বেস্ট সেলিং পয়েট বলা হয়। রুমির কিছু বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম হচ্ছে মাতনাওয়ে মানাউয়ি, দেওয়ান-এ শামস তাবরিজী, ফিমাফি, মজলিস-এ সভা, মাকাতিব।
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির জীবন বদলে দেয়া ১০ উক্তি
জনপ্রিয় এই সুফি সাধকের সাহিত্যকর্ম শুধু সাহিত্য গুনেই গুণান্বিত নয়। তার সৃষ্টির গভীরতা ব্যাপক। রুমীর সাহিত্যকর্মকে শেক্সপিয়রের সাথে তুলনা করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলার সামির আসাফ বলেছেন, ‘গভীরতার মানদণ্ডে রুমির তুলনায় শেক্সপিয়রের মান হচ্ছে মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ।’ মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি মানব প্রেমে দেখেছেন মুক্তি। তিনি সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষকে দেখেছেন একই দৃষ্টিতে। তাই তো তার শিক্ষা ধর্ম, বর্ণ ছাড়িয়ে স্পর্শ করেছে সকল মানুষের অন্তর।
জীবন দর্শন নিয়ে রচিত তার এসকল সাহিত্যকর্ম বদলে দিতে পারে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ছাপিয়ে যে কারো জীবন দর্শন। তার জ্ঞানগর্ভ রচনা থেকে জীবন বদলে দেয়ার মত বাছাইকৃত ১০ টি উক্তি এখানে তুলে ধরা হল।
১। তুমি সাগরে এক বিন্দু পানি নও। তুমি এক বিন্দু পানিতে গোটা এক সাগর।
২। আমাদের মধ্যে এক অদৃশ্য শক্তি লুকিয়ে আছে। এটা যখন দুটো বিপরীতমুখী বাসনার উপলব্ধি প্রকাশ করে তখন তা শক্তিশালী হতে থাকে।
৩। গতকাল আমি চতুর ছিলাম। তাই, আমি পৃথিবীটাকে বদলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমি জ্ঞানী। তাই, নিজেকে বদলে ফেলতে চাই।
৪। শোক করো না। তুমি যাই হারাও না কেন তা অন্য কোনো রূপে ফিরে আসবে।
৫। প্রত্যেককে বানানো হয়েছে নির্দিষ্ট কাজের জন্য এবং প্রত্যেক হৃদয়ে সেই কাজটি করার আকাঙ্ক্ষাও দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
৬। কেউ যখন কম্বলকে পেটাতে থাকে তখন সেটা কম্বলের বিরুদ্ধে নয়, ধুলোর বিরুদ্ধে।
৭। আমাদের চারদিকে সৌন্দর্য ছড়িয়ে রয়েছে। সাধারণত একে বুঝতে একটি বাগানে হাঁটার প্রয়োজন অনুভব করি আমরা।
৮। যখন নিজের মূল্য নির্ধারণের দিনটি আসবে তখন আপনার পরিচয় ফুটিয়ে তোলাটাই বিজ্ঞানের নির্যাস।
৯। শোক প্রকাশ হতে পারে সমবেদনার বাগান। যদি সবকিছুতে নিজের হৃদয়টাকে উদার রাখতে পারেন, বেদনা আপনার শ্রেষ্ঠ বন্ধু হতে পারে।
১০। আমার প্রথম প্রেমের গল্প শোনামাত্র তোমাকে খুঁজতে থাকি! কিন্তু জানি না ওটা কতটা অন্ধ ছিল। প্রেম আসলে কোথাও মিলিত হয় না। সারাজীবন এটা সবকিছুতে বিরাজ করে।
আমার কয়েক'টা আটিক্যালের লিংক, এখানে ক্লিক করেই পড়তে পারেন-
আপনার মৃত বাবা- মা’র জন্য আপনিই দোয়া করুন- কি কি দোয়া ও আমল করবেন?
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এক মুসলিম উপজাতীয় সম্প্রদায়ের কথা