দোষটা কি শুধুই মধ্যবিওের?

গত কয়েকমাসের করোনা দুর্যোগে সবচেয়ে বেশী ভোগান্তিতে পরেছে কোন শ্রেণীর মানুষেরা এ প্রশ্ন যদি কাউকে করা হয়, সহজেই যে উত্তর আপনি পাবেন তা হলো আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ। কোনমতে দু কি তিনমাস সারভাইভ করার পরে, ইদানীং তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অনুপাত হুট করেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্য চলে যাচ্ছে।

আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা, যারা কিনা বার্গারের দুপিস ব্রেড এর মাঝখানে থাকা বিফ অথবা ভেজিটেবল কিমার মত দিনরাত চেপেচুপে কোনমতে লাইফ সারভাইভ করে এবং মাস শেষে অবশ্যই মনযোগ দেয় ব্যাংকে নিজেদের সঞ্চয়ের দিকে, তাদের কেন শুধু আড়াই থেকে তিন মাসে পরেই এতো ভোগান্তি পেতে হবে? কেন তারা করোনার মত বড়সড় কোন দুর্যোগের ঝাপ্টায় অন্তত মাস ছয়েক অথবা বছর খানেক নিশ্চিন্তে তাদের ঢাকার সংসার কন্টিনিউ করতে পারছে না?

নেট দুনিয়ার কল্যানে ভাইরাল হওয়া মধ্যবিত্তের ঢাকা ছাড়ার ছবি আসলে কিসের প্রতিচ্ছবি? এই যে ঢাকার অলিতে গলিতে বিভিন্ন বাড়িতে  টু-লেট সাইনবোর্ড ঝুলছে, এর দ্বায়ভার কি সম্পুর্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আধুনিক এবং উচ্চবিলাসী জীবনযাপনের  চেষ্টা?  নাকি সরকার এবং সমাজের অন্যান্য, বিশেষ করে উচ্চবিত্তের ও এখানে কিছু ভূমিকা রয়েছে?

প্রিয় সুহৃদ,  আজকের আর্টিকেল এ আমরা বিশদ আলোচনা করবো আমাদের মধ্যবিত্ত  এবং করোনা দুর্যোগে তাদের বর্তমান  অবস্থান, তাদের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী কোন জিনিসগুলো এবং সর্বশেষে তাদের আরো কি করার সুযোগ ছিলো অথবা সোজা বাংলায় আদৌ তাদের কোন ভুল ছিলো কিনা।  তো চলুন অযথা বকবকানি বন্ধ করে মুল বিষয়ে মনোনিবেশ করা যাক।

আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় তাদের  অবস্থানঃ

বঙ্গ দেশের মত এমন রাইজিং টাইগারের দেশে এসে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী যাদের কে পেটি-বুর্জোয়া নামে অভিহিত করেন অনেকেই,বলা বাহুল্য দুরন্ত দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে আমাদের এই পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণী।

উন্নত দেশগুলোতে যেখানে মিডল ক্লাস স্ট্যাটাস ধারী লোকের সংখ্যা একটা গড়পড়তা সংখ্যায় প্রায় আবদ্ধ হয়ে আছে, অপরদিকে বাংলাদেশে গত প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বছরে দারিদ্র সীমার নীচের লোকজনের সংখ্যা কমেছে ৫৯ শতাংশ থেকে ২১.৮ শতাংশে।

বুঝতে পারছেন এই যে দারিদ্র সীমার অংক টা কমলো, এরা কোথায় গিয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে? এরাই কিন্তু আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে ট্রান্সফার হয়েছে। শুধু যে এরাই মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত হয়েছে তা কিন্তু নয়। প্রতিবছর যে বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় তারও  একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মধ্যবিত্ত সমাজে  প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে।

যাই হোক, সে একটা সময় ছিলো যখন আমাদের বাপ দাদারা এক জোড়া স্যান্ডেল অথবা দু'খানা লুঙ্গী দিয়ে দিব্যি বছর কয়েক কাটিয়ে দিতো। কিন্তু সময় এখন পাল্টেছে। আমার দাদা বলে,

চোখের পলকে সব কেমন পাল্টায় গেলো!!

তাইতো, যেভাবে এখন টেকনোলজি আপগ্রেডেশন হচ্ছে আর যেভাবে মানুষের লাইফস্টাইল পরিবর্তন হচ্ছে তার ছোঁয়া আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজেও বেশ ভালোভাবেই লেগেছে।

আগেরকার মধ্যবিত্তরা কখনো বছরে দু একটা ট্যুর দিতো না। কখনো এই উপলক্ষ ওই উপলক্ষ ইত্যাদিতে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে  গেট টুগেদার করতে যেতো না।

এখনকার মধ্যবিত্তরা কিছুটা আয়েশের জীবন চায়। চায় ব্র‍্যান্ডের ড্রেস অথবা কসমেটিকস ইউজ করে নিজেকে আরো স্মার্ট এবং ব্যাক্তিত্বময় করে তুলতে।

বছরে একটা কি দুটা ডোমেস্টিক অথবা ইন্টারন্যাশনাল ট্যুর দিতে পারা টা এখনকার মধ্যবিত্তের মোস্ট ডিজায়ার্ড ড্রিম বলা যায়। আমাদের বাপ দাদা রা বাইরে কোথাও খেতে যেয়ে হাজার হাজার টাকা বিল দিতো? তারা ব্র‍্যান্ড চিনতো? তারা কখনো চিন্তা করতো যে আগামি ছয় মাস স্যালারি থেকে কিছুটা সঞ্চয় করে একটা ব্র‍্যান্ডেড স্মার্ট ডিভাইস কিনবো?

লাইফস্টাইল এবং সময় কত পরিবর্তন হয়েছে একবার চিন্তা করেন। আমাদের আগের জেনারেশন থেকে কয়জন চিন্তা করতো দেশের বাইরে যেয়ে স্টাডি করার? অথচ এখন আমাদের মধ্যবিত্ত বাবা মায়ের একটা সুপ্ত ইচ্ছা থাকে নিজের ছেলেটাকে অথবা মেয়েটাকে দেশের বাইরে থেকে একটা দুটা উচ্চ ডিগ্রী অর্জন করে আনাবার।

এখন স্যাটেলাইট এর যুগ। প্রতি মাস শেষে প্রতিটা মধ্যবিত্তের খরচের টাকায় জমা হয় মোটা অংকের ইন্টারনেট বিল, মোবাইল বিল এবং ডিশ বিল। পাশাপাশি গ্যাস বিল, পানি বিল, ইলেক্ট্রিসিটি বিল এইসব এজ ইউজুয়াল বিল আর গণনায় নাই বা ধরলাম।

মোদ্দা কথা আগের মধ্যবিত্ত আর এখনকার মধ্যবিত্তের অনেক ফারাক। আগের মধ্যবিত্ত চাইতো কতটা হিসেব করে চলে দুটা টাকা সঞ্চয় করা যায়।এবং তাদের সে সুযোগ ছিলো। আর এখনকার মধ্যবিত্তরা চায় কিছুটা আয়েশের জীবন। কিছুটা আধুনিক জীবন, উচ্চবিত্তের সাথে তাল মিলিয়ে কিছুটা উচ্চবিলাসী জীবন। আর এই করতে যেয়ে বর্তমানে প্রায় মধ্যবিত্তের অবস্থা হয়েছে মাস শেষে স্যালারি যা আসে পুরোটাই খরচ!

তাই কস্টেকুস্টে টেনে টুনে এত্তসব শখ আহলাদ পুরন করে এই দাবী ওই দাবী মিটিয়ে যাও কিছু জমে, বড়জোর দুই কি তিনমাস টেনেটুনে চালানো যায় সংসার। তাও কত স্যাক্রিফাইস করতে হয়! একবেলা ডাল তো দুবেলা আলুভাজি।  এক দিন একটুখানি মাংস তো টানা এক দু সপ্তাহ ভেজিটেবল এভাবেই চলে আর কি।

এই করোনা দুর্যোগে যখন মিল কারখানা স্কুল কলেজ সব বন্ধ হয়ে গেছে, স্বভাবতই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যারা ছিলো, তারা তাদের অল্প জমানো টাকা দিয়ে কোনভাবে কিছুটা সময় ঢাকা শহরে চলতে পেরেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যেহেতু এই দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি তাই মধ্যবিত্ত লোকজন নিজের খেই হারিয়ে ফেলছে এই শহরের লাগামহীন উর্ধগতির জীবন যাত্রায় নিজেকে টিকিয়ে রাখতে।  মুলত এই কারনেই তারা অনেকেই ছাড়ছে ঢাকা, যাচ্ছে গ্রামের বাড়িতে বাপ দাদার শেষ ভিটায়।

মধ্যবিও পরিবার

আসলে কি আমাদের মধ্যবিত্তদের কোন ভুল আছে?

এ পর্যায়ে এসে এখন আপনি কি বলবেন? দোষ তাহলে মধ্যবিত্তের একলার? বলবেন তারা কেন আগের জেনারেশন এর মতো সঞ্চয় করে করে নিজেদেরকে দীর্ঘমেয়াদী দুর্যোগ মোকাবিলায় অর্থনৈতিক ভাবে প্রস্তুত রাখেনা?

আরে ভাই, এই করোনা দুর্যোগে যখন সরকার লকডাউনের ঘোষণা দিলো, তার পরদিন থেকে রাস্তায় রাস্তায় মানুষের আহাজারি!!  তাদের তেল নাই, নুন নাই, চাল ডাল কিছুই নাই। তারা কি মধ্যবিত্ত ছিলো? না তারা ছিলো সমাজের নিন্মশ্রেণীর লোকেরা। আপনার কি মনে হয় লকডাউনের পরের দিন থেকেই সবার ঘরের তেল নুন শেষ হয়ে যাওয়া খুব সম্ভব কাজ?

শুধু নিন্মবিত্ত কেন? সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কথাও যদি বলি, এই ধরেন গার্মেন্টস মালিক সমিতি। তারা কি করেছে? লক ডাউনের কয়েক দিনের মাথায় সরকার থেকে অনুদান চেয়ে বসে এবং কর্মী ছাটাই এর মত দ্বায়িত্বজ্ঞান হীন চিন্তাভাবনা ও শুরু করে। কেমন উচ্চবিত্ত এরা? এদের উচিত ছিলো যতদিন এই দুর্যোগ থেকে দেশ মুক্ত না হচ্ছে, মধ্যবিত্ত এবং নিন্মবিত্ত দের একটা নিরবচ্ছিন্ন  সাহায্যে প্রকল্পে সরকারের সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। তা না করে তারা নিজেরাই সরকারের মাথায় চেপে বসলো অনুদান অনুদান করে!

হ্যাঁ এটা ঠিক অনেকেই বলবে মধ্যবিত্তের একটা দোষ হলো তারা যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেদের গা এলিয়ে দেয়। তারা ভাবে যা হবার হবে পরে দেখা যাবে। তবে এটা কিন্তু সবক্ষেত্রে সঠিক নয়।মধ্যবিত্ত স্বার্থপর অথবা মধ্যবিত্ত কেয়ারলেস এটা ভাবার আগে বলেন, জাতীয় পর্যায়ের এক দুর্যোগ মোকাবিলার লক্ষ্যে মধ্যবিত্তরা তাহলে বছরের পর বছর রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে না, বাইরে ঘুরতে যাবে না, এমনকি ব্র‍্যান্ডের কোন জিনিসপত্র ও কেনাকাটা করতে পারবে না, এসবই আপনি বা আপনারা সমর্থন করেন বা করবেন? সিরিয়াসলি  গাইজ!!

অতঃপর, ভোগান্তি কিন্তু ঘুরেফিরে সেই মধ্যবিত্ত গণ্ডীতেই সীমাবদ্ধঃ

গভীর পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে,  এখানে সরকারের উচিৎ ছিলো আরো কঠোরভাবে দুর্যোগসময় এবং তার পরবর্তী কয়েকমাস দেশের অর্থনীতি কীভাবে সচল রাখা যায় যে ব্যবস্থা করা।

শুধু নিন্মবিত্তের জন্য রাস্তায় রাস্তায় সরকারি/বেসরকারি উদ্দ্যেগে দশ কেজি চাল সাথে সামান্য কিছু ডাল আলু তেল পেয়াজ অথবা উচ্চবিত্ত গার্মেন্টস মালিক সমিতি র জন্য বড় একটা সরকারি অনুদান, এই ছিলো আমাদের করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের সার্বিক ব্যবস্থা নেওয়া।

আমরা ফেসবুকে শুধু পোস্টের পর পোস্ট করেছি মধ্যবিত্তদের নিয়ে। কত মধ্যবিত্ত দিনের পর দিন না খেয়ে ছিলো, আমরা তার খবর কতটা নিতে পেরেছি? চিরাচরিত নিয়মে মধ্যবিত্তরা মুখ ফুটে বলতে পারেনি, আমার পেটে ক্ষুধা,  আমার বাসায় বাজার নেই, ফ্রিজে খাবার নেই বাসা ভাড়া বাকী। আর আমরা?সরকারী বলেন আর বেসরকারি বলেন কিছুই করতে পারিনি তাদের নুন্যতম প্রয়োজন টুকু মেটাতে। ফলে তারা বাধ্য হয়েছে না খেয়ে থাকতে, বাসা ভাড়া বাকী রাখতে এবং ফাইনালী ঢাকা ছাড়তে।

এই প্রিয় ঢাকা যেখানে তাদের বিশ ত্রিশ বছরের সাজানো সংসার, কোন পরিস্থিতিতে পরে ছেড়ে চলে যাচ্ছে গ্রামের দিকে ভাবতে পারেন?

বলা হয়ে থাকে মধ্যবিত্তরাই অর্থনীতির অন্যতম চাকা। কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে আমি আজকের আর্টিকেলটি শেষ করবো।  এই যে মধ্যবিত্ত নামক অর্থনীতির চাকাগুলোতে ঘুনে ধরে অকেজো আর অসাড় হয়ে যাচ্ছে , সামনে দেশের অর্থনীতি একলা শুধু উচ্চবিত্ত অথবা নিন্মবিত্তেরাই  সচল করবে তাহলে? সম্ভব এটা?

পরিশেষে,

মড়ার উপর খাড়ার ঘা এর মত পাটকলগুলো বন্ধ না করে  সুদুরপ্রসারি এবং ফলপ্রসূ কিছু ভাববার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি!

করোনা দুর্যোগ হয়তো আগামী কয়েক মাসেই স্বাভাবিক হতে পারে কিন্তু করোনা দুর্যোগ পরবর্তী বছরগুলোতে আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি চালু রাখা এবং সমাজের মধ্যবিত্ত অথবা নিন্মবিত্তদের  মৌলিক চাহিদাগুলো  যথাযথ পুরন করার মত চ্যালেঞ্জিং কার্যক্রম এ সরকার এবং সমাজের উঁচুতলার লোকজনকে একসাথে এগিয়ে আসার প্রয়াস দেখাতে হবে।

আমার কয়েক'টা আটিক্যালের লিংক, এখানে ক্লিক করেই পড়তে পারেন-

ক্যাপ্টেন শুভমের লকডাউন

সবাই তো সুখি হতে চায় – আপনার কাছে সুখ মানে কি?

আবেগ কে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখুন- আবেগে গা ভাসাবেন না

কি ভাবে আপনার সন্তানের সাথে সেক্স নিয়ে কথা বলবেন?

ফিনিক্স পাখি: রুপকথায়- আগুনে জন্ম যে পাখির

Click Here to Leave a Comment Below 0 comments

Leave a Reply: